বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক, নারীদের জন্য কেন ঝুঁকি ও সম্ভাব্য সমস্যা?
সমাজে এমন পুরুষদের সংখ্যা কম নয়, যারা শুধুমাত্র নারীদেহ ভোগের উদ্দেশ্যেই প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে এবং কাজ হাসিল হলে দায়িত্ব নিতে চান না। নারীদের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটে, তবে তুলনামূলকভাবে এর সংখ্যা কম। আশঙ্কার বিষয় হলো, আজকাল অনেক উঠতি বয়সী মেয়েই এই ধরনের শারীরিক সম্পর্ককে ‘আধুনিকতা’ বলে মনে করে। কিন্তু বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কের ফলে যে গুরুতর সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে, তার বেশিরভাগই নারীদের পোহাতে হয়। মোদ্দাকথা হলো, বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক নারীদের ঠেলে দিতে পারে নানাবিধ মারাত্মক ঝুঁকি ও সমস্যার মুখে।
চলুন জেনে নিই অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যাগুলো সম্পর্কে:
১. অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ঝুঁকি
বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি হলো অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ। নিরোধক ব্যবহারের পূর্ব পরিকল্পনা না থাকা, অথবা আবেগের বশে হুট করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাই এর প্রধান কারণ। সমাজের বাস্তবতায়, শারীরিক সম্পর্কের ‘চিহ্ন’ সাধারণত নারীদের দেহেই ধারণ হয়, এবং গর্ভধারণের যাবতীয় সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয় শুধু তাদেরকেই। এর ফলে পরিবার, সমাজ এবং নিজের কাছে অপরাধী হতে হয় নারীদের, যা তাদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
২. ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাত এবং এর কুফল
যদি বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কের ফলে গর্ভধারণ ঘটে যায়, তবে অনেক সময় গর্ভপাত করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। গর্ভপাত একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক ক্ষতিরও কারণ হতে পারে। গর্ভপাতের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে। এর দীর্ঘমেয়াদী কুফলও রয়েছে, যেমন – পরবর্তীতে গর্ভধারণে সমস্যা হওয়া বা সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারানো। বিশেষ করে প্রথম সন্তান জন্মদানের আগে গর্ভপাতের ঘটনা ঘটলে, পরবর্তীতে সন্তান ধারণে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গর্ভপাতের মানসিক ক্ষতিও কম নয়; সন্তান হারিয়ে অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, এমনকি অনেকে বিকারগ্রস্ত পর্যন্ত হতে পারে।
৩. জন্মনিরোধক পিল ও অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি
বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কের কারণে অনেকেই জন্মনিরোধক পিল বা অন্যান্য ওষুধ গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু অনবরত জন্মনিরোধক পিল গ্রহণ সাময়িকভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধ করলেও, দীর্ঘমেয়াদে তা মারাত্মক সব সমস্যার কারণ হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সন্তানধারণের ক্ষমতা হারানো। প্রথম সন্তান জন্মের আগেই দীর্ঘদিন পিল গ্রহণের ফলে পরবর্তীতে গর্ভধারণে ঝুঁকি হতে পারে, বারবার গর্ভপাতের সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এছাড়া, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, মুটিয়ে যাওয়া, খাবারে অনীহা এবং সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
৪. অপরিণত বয়সে যৌন সম্পর্কের ঝুঁকি
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে শারীরিক বিষয়াবলির প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। ফলে প্রেমের সম্পর্কে কোনো কিছু না ভেবেই শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। কিন্তু অপরিণত বয়সে শারীরিক সম্পর্কের পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। এর ফলে যৌনসংক্রমণ, এমনকি ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ সব রোগ হতে পারে। বিশেষ করে কমবয়সী মেয়েরা সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে থাকে। জরায়ুমুখ সংক্রমণ এবং জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঝুঁকি তাদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ থাকে।
৫. মানসিক ভীতি ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন সাধারণত লুকিয়েই করা হয়ে থাকে। এই বিষয়টি পরবর্তীতে একজন নারীর জন্য মানসিক ভীতি বা বিকারের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে প্রেমিকেরা অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রেমিকাকে চাপ প্রয়োগ করে মিলিত হয়ে থাকে। পরে সম্পর্ক ভেঙে গেলে এসব ঘটনা অনেক মেয়ের উপর এমন মানসিক চাপ ফেলে, যা ক্রমশ বিকারে রূপ নেয়। যেমন – শারীরিক সম্পর্কে অনীহা বা ভীতি, বিবাহভীতি, পুরুষদের প্রতি ঘৃণা বা ভয় ইত্যাদি। এর ফলে যেমন প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে, তেমনি বিয়ের সম্পর্কেও ভাঙন আসতে পারে।
৬. বিয়ের পর দাম্পত্যে সমস্যা
যদি বিয়ের আগে প্রেমিকের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়ানো হয়, তবে দাম্পত্যজীবনেও নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। নারীরা স্বামীর অবিশ্বাসের পাত্রী হতে পারেন। এমনকি প্রেমিকের সাথেই বিয়ে হলেও, তিনি পরবর্তীতে নানা রকমের দোষারোপ করতে পারেন, বা চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করতে পারেন। ঝগড়ার সময় হয়তো কথায় কথায় বলতে পারেন যে, যেহেতু তার সাথে বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক ছিল, হয়তো আরও অনেকের সাথেই ছিল। মোটকথা, দাম্পত্যের প্রতিটি পদে নারীকে নানা রকমের কটু কথা শুনতে হতে পারে।
৭. দাম্পত্যে আকর্ষণ হারানো
অনেক ভালোবাসার সম্পর্কই বিয়ের পরিণতি পায়। কিন্তু যেহেতু স্বামীর সঙ্গে বিয়ের আগে থেকেই শারীরিক সম্পর্ক থাকে, তাই অনেকেই দাম্পত্যজীবনে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে পারেন। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের কাছ থেকে নতুন কিছু পাওয়ার থাকে না বলে বিয়ের সম্পর্কে ভাঙনের সুর বাজতে পারে। অনেকে বাগদান বা আংটি বদল সম্পন্ন করে একটি দৃঢ় বন্ধন তৈরি হয়েছে ভেবে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যান। কিন্তু বাগদানের পর বিয়ে ভাঙার ঝুঁকি তো থাকেই, সাথে রয়ে যায় দাম্পত্য আকর্ষণহীন হয়ে যাওয়ার শঙ্কাটাও।
৮. সামাজিক লাঞ্ছনা ও একঘরে হওয়া
বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে নারীরা হন নানা রকম লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার। সমাজ তাকে অপরাধীর দৃষ্টিতে দেখে এবং তার জীবন বিষময় হয়ে ওঠে। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করলে এবং সেটার কথা জানাজানি হলে ফলাফল হয় ভয়াবহ। মেয়েটি সামাজিকভাবে হয়ে যায় একঘরে। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সকলেই দূরে চলে যায় এবং তাকে পাপীর দৃষ্টিতে দেখে। ফলে সুষ্ঠুভাবে বাকি জীবন কাটানো অসম্ভব হয়ে যায়, জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সুস্থ ও নিরাপদ সম্পর্ক গড়া নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই অপরিহার্য। আপনার কি মনে হয়, এই ধরনের সচেতনতা সমাজে আরও বাড়ানো উচিত?