“বাংলায় কথা বললেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে”- স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে ৬ বছরের শিশু! জেনেনিন বিস্তারিত

গুরুগ্রামে পুলিশের বেআইনি বাংলাদেশি নাগরিক খোঁজার অভিযানকে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ৬ বছর বয়সী শেহনাজ খাতুন, যার বাবা একজন পরিযায়ী শ্রমিক, সে ভয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। তার সরল কথায়, “আমি যাচ্ছি কালকে লোকজনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মারছে, পিটছে। আমার বাবাকে নিয়ে ভয় করছে। আমার স্কুল বন্ধ হয়ে গেল।” শেহনাজের এই ভয়ের কারণ একটাই – বাংলাভাষী হওয়ার দরুন তার পরিবারের সদস্যরাও কখন পুলিশের স্ক্যানারে চলে আসে, এই চিন্তা।

ভয়ের বাতাবরণ: এক আতঙ্কগ্রস্ত কলোনি
গুরুগ্রামের কিউ ব্লকে অবস্থিত বাঙালি কলোনিগুলিতে এখন থমথমে পরিবেশ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশ ছিল বেআইনি বাংলাদেশি নাগরিকদের খুঁজে বের করার, কিন্তু বাস্তবে এই তল্লাশি অভিযান অন্য মাত্রা নিয়েছে। রাতারাতি ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছেন বাংলাভাষী মুসলিমরা। অনেকেরই প্রশ্ন, এই অভিযানে ভারতীয় নাগরিকদের কি ক্রিমিনাল হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে না তো?

গুরুগ্রাম পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এই অঞ্চলের ৩৫০ থেকে ৪০০ জন বাঙালি মুসলিম পুলিশের স্ক্যানারে রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০ জনকে ‘বেআইনি বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। তবে এর মধ্যে কি সত্যিই নির্দোষ ভারতীয় নাগরিকরাও রয়েছেন?

যাচাই-বাছাইয়ের নামে হেনস্থা
পুলিশি অভিযানের ধরণ দেখে স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। সিভিল ড্রেসে থাকা পুলিশ সদস্যরা চা-এর দোকান, নির্মাণাধীন স্থান এমনকি ঘরের ভিতর থেকেও বাংলাভাষী মুসলিমদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের স্থানীয় ৪টি কমিউনিটি সেন্টারে আটকে রাখা হচ্ছে। পরিচয়পত্র দেখাতে পারলে মুক্তি মিলছে, কিন্তু কাগজপত্রের অভাবে যাদের পরিচয় প্রমাণ করা সম্ভব হচ্ছে না, তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। কেউ ২ দিন, কেউবা ৫ দিন ধরে আটক রয়েছেন। আতঙ্কে অনেকে বাক্স-পেঁটরা গুটিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ফেরার তোড়জোড় করছেন।

৫০ বছর বয়সী কবীর, যিনি দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তার পাসপোর্ট ও ভোটার কার্ড থাকা সত্ত্বেও তাকে ৩ দিন থানায় আটকে রাখা হয়েছিল। তার ছেলেকে আটকে রাখা হয় ৫ দিন। “বাবার জন্মের কাগজ দেখতে চেয়েছিল ওরা। কীভাবে দেখাব? বাবাকেই কখনও চোখে দেখিনি,” হতাশ কণ্ঠে বললেন কবীর। তার অভিযোগ, “এগুলো হচ্ছে একমাত্র কারণ আমরা বাংলায় কথা বলি।”

অভিযোগ অনুযায়ী, ঘটনার ক্রমটি অনেকটা এরকম: বাংলায় কথা বললেই পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে, থানায় আটকে রাখা হচ্ছে, এবং বাংলাদেশি নন প্রমাণ দিতে পারলেই কেবল মুক্তি মিলছে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হচ্ছেন পরিযায়ী শ্রমিক এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষেরা।

বাংলা ভাষা নিয়ে বিভ্রান্তি এবং টার্গেট শুধু বাঙালি মুসলিম?
বাংলা ভাষার নানা উপভাষা (যেমন: রাঢ়ি, রাজবংশী, সিলেটি, চিটাগং এবং নোয়াখালি, বরিশালি, খুলনা, ফরিদপুরী) থাকার কারণে প্রায়শই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ভাষার টানের সঙ্গে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভাষার টান মিলে যায়। আর এই ভাষা বিভ্রাটই অবাঙালি পুলিশকর্মীদের বিভ্রান্ত করছে। মুর্শিদাবাদ, মালদা বা কোচবিহারের বাসিন্দাদের ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের রংপুরের ভাষার টানের মিল থাকতে পারে, যা গুরুগ্রামের পুলিশের পক্ষে আলাদা করা কঠিন।

এক বাংলাভাষী মহিলা কান্নাভেজা চোখে বলেন, “আমি বাঙালি। কিন্তু ভগবানকে কি আমি বলতে গিয়েছিলাম আমায় বাংলায় জন্ম দিন বা মুসলিম ঘরে? আপনি আপনার ধর্ম পেয়েছেন, আমি জন্মসূত্রে আমারটা পেয়েছি। কিন্তু বাংলাই আমার মাতৃভাষা। তার জন্য অত্যাচারিত হতে হবে?” ৪৭ বছর বয়সী আরও এক বাঙালি মহিলা জানালেন, “রাত ১টার সময়ে আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেল। ৫ দিন আটকে রাখল। কোনও FIR নিল না। শুধুমাত্র আমরা বাংলায় কথা বলি বলে? কই হিন্দুদের তো তুলে নিয়ে যাচ্ছে না। শুধু মুসলিমদেরই টার্গেট করছে কেন?”

এই পরিস্থিতিতে গুরুগ্রামের বাঙালি কলোনিগুলোতে এক গভীর অনিশ্চয়তা এবং আতঙ্কের ছায়া নেমে এসেছে। এই অভিযান কি সত্যিই শুধুমাত্র বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের ধরার জন্য, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *